অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার সংক্ষেপে ‘ওসিডি’ বা বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘শুচিবাই’। এই রোগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই ভুক্তভোগীর কষ্টকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার আগেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আবার চিহ্নিত হওয়ার পরও এর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে থেকে যায় বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি।
ওসিডি হলো এমন একটা দুশ্চিন্তামূলক অসঙ্গতি। যেটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- অনিয়ন্ত্রিত এবং অগ্রহণযোগ্য চিন্তাভাবনা, যা আপনাকে দখল করে নেয় এবং ফলশ্রুতিতে একই ধরনের কাজ বারবার করে যেতে হয় অনেকটাই বাধ্য হয়ে। লক্ষ্য করবেন এদের চিন্তাভাবনাগুলো অনেকটাই যুক্তিহীন। কিন্তু কোনোভাবেই একই ধরনের আচরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছেন না এদের। সে কাজটিই যেন তার করা জরুরি।
অবসেসনটা কী আর কমপালসনটাই বা কাকে বলে?
অবসেসন হলো এমন চিন্তাভাবনা, দৃশ্যাবলি বা তাড়না, যেগুলো আপনার কাছে কাম্য নয়। প্রায় অনিয়ন্ত্রিত এবং দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশান্তিকর এবং কষ্টকরও বটে। আপনি জানেন যে এই ধরনের চিন্তা অর্থহীন কিন্তু তাদের আসাটা থামাতে পারেন না। ওরা বার বার আপনার মনোজগতে হানা দিতে থাকে।
অন্যদিকে কমপালসন হলো এমন সব আচরণ বা অভ্যাস, যেগুলো অবসেশন থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে বার বার প্রায় বাধ্য হয়েই করতে হয়। যেমন- হাতটা ময়লা হয়ে আছে ভাবা (এটি অবসেসন), এটি মনে করে বার বার হাত ধুয়ে আসা (এটি কমপালসন)। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মুক্তিটা সাময়িক। সাধারণত প্রতিবারই কমপালসিভ আচরণ পালন করার পর অবসেসনটা আরও শক্তিশালী হয়ে ফেরত আসে আর শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি করে উদ্বেগ আর উত্তেজনার।
ওসিডি কত প্রকারের হতে পারে?
ওয়াশারস (পরিষ্কারকারী) : এরা ‘ময়লা লেগে আছে’ এই অবসেসনে ভোগে। এদের কমপালসিভ বিহেভিয়র হয় সাধারণত বার বার হাত ধোয়া বা কাপড় ধোয়া।
চেকারস (পরীক্ষাকারী) : এরা সবকিছু বার বার চেক করতে থাকেন যে, বিষয়গুলোর সাথে দুর্ঘটনার একটা যোগসূত্র আছে; দরজাটা লাগানো হয়েছে কি না, পানির কলটা বন্ধ করলাম কি না, চুলা নিভানো হয়েছে কি না, এইসব।
ডাউটারস অ্যান্ড সিনারস (সন্দেহবাদী এবং পাপী) : এদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে যে, যদি সবকিছু ঠিকঠাকমতো না হয়, তাহলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে আর তার কারণে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।
কাউন্টারস অ্যান্ড অ্যারেঞ্জারস (গণনাকারী এবং গোছানোকারী) : এদের অবসেসন থাকে ক্রম (অর্ডার) এবং গোছানোর (অ্যারেঞ্জ) প্রতি। এদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ নম্বর বা রং বা সজ্জার ব্যাপারে একটা কুসংস্কার দেখা যায়।
হোর্ডারস (দখলকারী) : এরা কোন কিছুই ফেলতে চায় না, তা তাদের দরকারে না লাগলেও। এদের ধারণা, যদি কোন কিছু ফেলে দেয়া হয়, তাহলে ভয়ংকর খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। বা পরে কখনও দরকার লাগতে পারে।
একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, কোনো অবসেসিভ চিন্তাভাবনা থাকা বা কোনো কমপালসিভ কাজ করা মানেই কিন্তুু আপনি ওসিডিতে আক্রান্ত, এমন ভাবাটা ভুল। বেশিরভাগ মানুষেরই স্বল্পমাত্রায় অবসেসনে ভোগেন বা কোনো কমপালসিভ আচরণ করার অভ্যাস থাকতে পারে এবং তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু ওসিডিতে আক্রান্তরা প্রচণ্ড স্ট্রেসে ভোগেন। কমপালসিভ কাজের কারণে অনেক সময় নষ্ট হয়। ফলশ্রুতিতে তাদের পারিবারিক, সামাজিক জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে।
ওসিডির লক্ষণ :
বেশিরভাগ মানুষ অবসেসন এবং কমপালসন দুটোতেই ভোগে। আবার কেউ কেউ এদের যে কোনো একটিতে আক্রান্ত। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে ওসিডি বাড়তে-কমতেও দেখা যায়। মজার ব্যাপার হলো- সাধারণত মানসিক চাপের সময় ওসিডির প্রভাব বেড়ে যেতে দেখা যায়।
ওসিডির ক্ষেত্রে সাধারণ অবসেসিভ চিন্তাভাবনাগুলো :
১. নোংরা হওয়া বা নোংরা লাগার ভয়
২. নিজেকে বা অন্যকে আহত করা বা কষ্ট দেয়ার ভয়
৩. যৌন চিন্তাভাবনা বা দৃশ্যাবলি
৪. জিনিসপত্র, যার কোনই প্রয়োজন নেই, সেগুলো হারিয়ে ফেলার ভয়
৫. ধর্মীয় উন্মাদনা বা অতিরিক্ত নীতিবোধ
৬. সবকিছু গুছিয়ে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাখার ইচ্ছা
৭. কুসংস্কার, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতা, ইত্যাদি।
ওসিডির ক্ষেত্রে সাধারণ কমপালসিভ আচরণগুলো :
যেমন- দরজার তালা দেয়া আছে কি না, পানির কল বন্ধ করা হয়েছে কি না, লাইট-ফ্যানের সুইচ অফ করা হয়েছে কি না। প্রিয় মানুষের অতিরিক্ত খোঁজখবর রাখা যে তার নিরাপদ আছে আছে কি না। বারবার গোনা, লেখা- কোনো জিনিস বার বার পরীক্ষা করা, এরকম অর্থহীন কাজ করা। দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য। ধোয়ামোছার জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা। বারবার জিনিসপত্র গোছানো। অতিরিক্ত ধর্মকর্ম করা বা এমনসব ধর্মীয় আচার পালন করা যেগুলো ধর্মসংক্রান্ত ভয় থেকে উদ্ভূত। পুরোনো বাতিল জিনিসপত্র জমা করে রাখা, ইত্যাদি।
কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন অবসেসিভ কমপালসিভ বিহেভিয়র :
থেরাপি থেকে শুরু করে ইচ্ছাশক্তি বা মেডিটেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে, সবচেয়ে কার্যকরি উপায় হলো ‘কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি’ বা সিবিটি। সিবিটির রয়েছে দুটো অংশ-
১. সংস্পর্শ এবং তৎজনিত সাড়া প্রতিরোধকরণ (এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনসন) : এই অংশে রোগীকে বার বার তার অবসেসিভ পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয় কিন্তু স্ট্রেস কমানোর জন্য সে যে কমপালসিভ বিহেভিয়র দেখাতো, সেটা করতে দেয়া হয় না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একজন ওসিডি রোগী, যার কিনা বার বার হাত ধোয়ার অভ্যাস। তাকে একটা পাবলিক টয়লেটের দরজার নব ধরতে বলা হয়। তারপর তাকে হাত না ধুতে দিয়ে বসিয়ে রাখা হয় যেন তার হাত না ধুতে পারাজনিত উদ্বেগটা বাড়তে থাকে। এভাবে এক সময় দেখা যায় যে তার উদ্বেগটা (অবসেসন এবং সংশ্লিষ্ট কমপালসিভ বিহেভিয়র) চলে যায়। ফলে রোগী বুঝতে পারে যে, অ্যাংজাইটি হলেই সেটা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মু্ক্তি পাওয়ার জন্য পাগল হওয়ার দরকার নেই, কারণ এটা তার কোন ক্ষতিই করছে না আসলে। এভাবে অবসেসিভ চিন্তাভাবনা এবং কমপালসিভ আচরণের ওপর তার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ধরনের প্রতিরোধ পদ্ধতি আসলে মস্তিষ্ককে নতুন করে ট্রেনিং দেয়, ফলস্রুতিতে ওসিডির লক্ষণগুলো আস্তে আস্তে দুর্বল হতে হতে একসময় পুরোপুরিই চলে যায়।
২. কগনিটিভ থেরাপি : কগনিটিভ থেরাপি আসলে ফোকাস করে ওসিডি রোগাক্রান্ত রোগীর ক্ষতিকারক চিন্তাভাবনা এবং অতিরিক্ত দ্বায়িত্ববোধজনিত ব্যাপারগুলোর ওপর। কগনিটিভ থেরাপি চিকিৎসার একটা বড় অংশ হলো রোগীকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া, যেন সে তার কমপালসিভ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ না করেই সুস্থ্ এবং কার্যকরীভাবে অবসেসিভ চিন্তাভাবনার সময়গুলোতে সাড়া দিতে পারে।
মনোস্তত্ত্ববিদ জেফরি সোয়ার্টজের ‘অবসেসিভ চিন্তা ও কমপালসিভ তাড়না’ জয়ের চারধাপী কৌশল :
প্রথম ধাপ ‘রি-লেবেল’ : উপলব্ধি করা যে অনাকাঙ্ক্ষিত অবসেসিভ চিন্তা এবং সে বিষয়ক তাড়না ওসিডির কারণে হচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপ ‘রি-অ্যাট্রিবিউট’ : উপলব্ধি করা যে, ওসিডির কারণে যে অবসেসিভ চিন্তা এবং সে বিষয়ক তাড়নার তীব্রতা সম্ভবত মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক অসমতার সাথে সম্পর্কিত।
তৃতীয় ধাপ ‘রি-ফোকাস’ : ওসিডিজনিত চিন্তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্য কিছুর ওপর স্থাপন করা, অন্ততপক্ষে কিছু সময়ের জন্য হলেও। অর্থাৎ অন্য কিছু করা।
চতুর্থ ধাপ ‘রি-ভ্যালু’ : ওসিডি চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে মূল্যায়িত করা। ওগুলো অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়- এভাবে ভাবা। অন্যান্য উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে মেডিটেশন, ফ্যামিলি থেরাপি এবং গ্রুপ থেরাপি।
নিজেই নিজের ওসিডির চিকিৎসা করুন :
নিজেই আপনি ওসিডি থেকে মুক্তির চেষ্টা শুরু করতে পারেন। নিজেকে শিক্ষিত করে তুলুন ওসিডির ব্যাপারে। এ সম্পর্কিত বই পড়ুন, ডাক্তারের সাথে কথা বলুন, অন্য ওসিডি রোগীর সাথে আলাপ করুন। আপনি ওসিডির ব্যাপারে যত বেশি জানবেন, ততই সহজে এবং কার্যকরীভাবে এর মোকাবেলা করতে পারবেন। অনুশীলন করুন থেরাপি থেকে যা শিখেছেন। শুধু জানলেই হবে না, বরং প্রতিদিন নিয়ম করে আন্তরিকতার সাথে অনুশীলনও করতে হবে কার্যকরী পদ্ধতিগুলো। নিজের পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সাথেই থাকুন। ওসিডির কারণে যদি আপনি একাকী হয়ে যেতে চান, তাহলে ওসিডি না কমে কিন্তু বেড়ে যেতে পারে। তাই পরিবার আর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা খুই গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য ওসিডি সাপোর্ট গ্রুপ আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনি দেখবেন যে, এই সমস্যায় আপনি একা নন। রিল্যাক্স করার পদ্ধতিগুলোর অনুশীলন করুন। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, গভীর শ্বাস নেয়া- এরকম অনেক পদ্ধতি আছে যা আপনার উপকারে আসবে।
কিভাবে ওসিডি আক্রান্ত প্রিয় মানুষটাকে সাহায্য করবেন?
আপনার প্রিয় মানুষটির ওসিডির সমস্যায় আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান সেটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেতিবাচক মন্তব্য বা সমালোচনা ওসিডির অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলতে পারে, যেখানে ইতিবাচক সাহায্য চিকিৎকসায় সফলতা নিয়ে আসে। কখনই ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তিকে বলা যায় না যে, তুমি তোমার এইসব আচরণ বন্ধ কর বা তাকে বাধ্যও করতে যাবেন না। আপনাকে বুঝতে হবে, ওসিডিতে আক্রান্ত বলেই তারা তাদের ওইসব আচরণ বন্ধ করতে পারছে না। তাকে এ ব্যাপারে চাপ দিলে তার প্রতিক্রিয়াজনিত আচরণ আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। সুতরাং আপনার প্রিয় মানুষটাকে ওসিডির সাথে লড়াইয়ে জয়ী করতে চাইলে তার সাথে যতটা সম্ভব দয়ালু এবং ধৈর্যশীল আচরণ করুন। ওসিডি নিয়ন্ত্রণের লড়াই তার প্রতিটা সফল পদক্ষেপের প্রশংসা করুন এবং তার চরিত্রের ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে আপনার মনোযোগ দিন।
সবার আগে আপনার নিজের জানতে হবে ওসিডি সম্পর্কে। যত ভালোভাবে আপনি জানতে পারবেন, ততই কার্যকরীভাবে আপনি ওসিডি আক্রান্ত আপনার প্রিয় মানুষটাকে সাহায্য করতে পারবেন। আপনি নিজে জানলে তাকেও জানাতে পারবেন। অন্তত তাকে যদি এতটুকুও বলা যায় যে, ওসিডি একটি নিরাময়যোগ্য সমস্যা। তাহলেও আপনি তাকে মনোবিদের চেম্বারে যাওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন।